জমে উঠেছে নাটকপাড়া। একের পর এক মঞ্চায়ন হচ্ছে নতুন নতুন নাটক। ব্যতিক্রমী পরিবেশনা নিয়ে আসছে দলগুলো। তেমনই একটি ‘সাতকাহন’। নবরস নৃত্য ও নাট্যদলের ৪র্থ প্রযোজনা এটি। ভিন্নধর্মী একটি গল্পের নাটকটি দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছে। শামীম সাগরের রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা।
চলতি বছরের প্রথম দিন এ উপলক্ষে গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ শো করেছে দলটি। আর দর্শকের জন্য বছরের শুরুতে ২-৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তন মঞ্চে প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয়।
নাটকের গল্পে দেখা যায়, এক পাঁচতারকা হোটেলের লিফটে যান্ত্রিক ত্রুটি। এরই সঙ্গে শহরের ব্ল্যাকআউটে আটকা পড়ে তিন ভিন্ন জগতের তিন নারী। এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী উঠতি অভিনেত্রী, এক গৃহবধূ, আর এক যৌনকর্মী। প্রথমে সন্দেহ, তর্ক আর অপমানের জালে জড়িয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে নিজেদের জীবনের গল্পে তারা একে অপরকে চিনতে শুরু করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণ, বঞ্চনা আর ব্যক্তিগত সংগ্রামের গল্প তাদের এক অদ্ভুত বন্ধনে আবদ্ধ করে। লিফট সচল হলে, নির্দিষ্ট ফ্লোরে পৌঁছেও তারা আর বের হয় না। কারণ তারা বুঝে গেছে, তারা একই পুরুষের প্রতারণার শিকার এবং একে অপরের শত্রু নয়; বরং একই লড়াইয়ের সহযাত্রী। নাটকে তিন নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন রোজী সিদ্দিকী, সৈয়দা শামছি আরা ও মিতা গাঙ্গুলী।
উচ্চবিত্ত বিলাসবহুল জীবনের মধ্যে আসলে যে নারী অধিকারহীনতা, নারীর যন্ত্রনা ও নারী স্বাধীনতার অভাব রয়েছে তা নাটকের মধ্যে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্দেশক। এ নাটকের কাহিনি পরম্পরা। উচ্চবিত্ত জীবন নিয়ে এ ধরনের নাটক মঞ্চে আগে কখনও হয়নি। রোজী সিদ্দিকী, সৈয়দা শামছি আরা ও মিতা গাঙ্গুলীর অভিনয় ছিল অসাধারণ। তাদের প্রাণবন্ত অভিনয়, মিউজিক, লাইট ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে অনবদ্য পরিবেশনা ছিল। তবে পোশাকে নারী চরিত্রগুলো স্টাবলিস্ট হয়নি। পোশাকে কিছু পরম্পরাহীনতা মনে হয়েছে। তিনজন নারী প্রায় একই রকম ড্রেস পরেছেন, যে কারণে চরিত্রবিন্যাস আলাদাভাবে বুঝতে একটু অসুবিধা হয়েছে।
নাটকটি প্রসঙ্গে নাট্যকার শামীম সাগর বলেন, “নারীকেন্দ্রিক একটি নাটক লেখার অনুরোধ করেছিলেন নবরসের কর্ণধার শামছি সায়েকা। তখন থেকেই ভাবনাটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল; একসময় লেখার সূত্রটা মগজে ধরা দিল।
এরপরই ‘সাতকাহন’ রচনার যাত্রা শুরু হয়। আশা করি দর্শক নারীদের সাতকাহন দর্শন ও শ্রবণে ভাবিত হবেন, আবেগে ভাসাবেন নিজেদের, অন্তরের আয়নায় নিজেদের নতুন করে দেখবেন নিশ্চিতভাবে। আপনাদের ভালোলাগা আমার অনুপ্রেরণা। আপনাদের ভালোবাসা সাতকাহনকে পূর্ণতা দেবে।’
নির্দেশকের ভাষ্য, “নবরস দল থেকে শুধু নারীদের নিয়ে নাটক করার ইচ্ছা ছিল, বিশেষ করে সাতকাহন গল্পটার মতো পাণ্ডুলিপিতে। এমন একটি বিষয় নিয়ে নাটক করার তাড়না অনেক দিন ধরে মনে ধারণ করেছিলাম। নাটকটি মঞ্চে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য হলো, সমাজে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা। তবে তা সম্ভব না জেনে-বুঝেও চেষ্টাটুকু করা মাত্র। শামীম সাগরের এমন নিপুণ আর শৈল্পিক লেখায় মুগ্ধ আমরা সব অভিনয় শিল্পীরা। ধন্যবাদ জানাই তাকে ও নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত কলাকুশলী ও নেপথ্যে যুক্ত সব শিল্পীবৃন্দের।
কন্যা-জায়া-জননী এই ৩টি শব্দের তাৎপর্য বিশাল। একজন নারীকে মা হিসেবে, কন্যা হিসেবে বা স্ত্রী হিসেবে যে সম্মান সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন তা অতুলনীয়। সৃষ্টিকর্তা যে সম্মান, গুরুত্ব ও মর্যাদা নারীদের দিয়েছেন, সে দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবারের সমাজের কাছ থেকে, পাচ্ছে কিনা বা মিলছে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান গোটা পৃথিবী। পুরুষশাসিত সমাজে সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, নারীদের জীবনের এই নাটকীয় অবস্থান।”
প্রযোজনাটির পোশাক পরিকল্পনা করেছেন ওয়াহিদা মল্লিক জলি। সংগীত পরিকল্পনা করেছেন গোপী দেবনাথ। নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন সৈয়দা শামছি আরা সায়েকা। আলোক পরিকল্পনা করেছেন পলাশ হেন্ড্রি সেন আলো। সেটা ডিজাইন করেছেন শামীম সাগর।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন