বাংলা সাহিত্যের কাল পুরুষের প্রয়ান দিবসে ভক্তের শ্রদ্ধায় স্বরন

বাংলা সাহিত্যের কাল পুরুষের প্রয়ান দিবসে ভক্তের শ্রদ্ধায় স্বরন


-রেডিও শহর ডেস্ক
 

মা আয়েশা ফয়েজের স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ। 
-----------------------------------------------

"একেবারে বিয়ের প্রথম দিকের কথা বলি। প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। বউ ওঠানো হয়েছে, আত্মীয়স্বজনে ঘর ভরে গেছে। আমি তো এর আগে হুমায়ূনের বাবার কণ্ঠ শুনিনি। কিন্তু অনেক রাগারাগি হচ্ছে শুনতে পাচ্ছি। তখন ওই বাড়িতে নিয়ম ছিল, নতুন বউ এলে বউকে পান্তা ভাত আর শাড়ি দিয়ে বলবে, এই তোমাকে ভাত-কাপড় দিলাম। এটা বউ ঘরে তোলার একটা রীতি। কিন্তু হুমায়ূনের বাবা এটা মানবেই না। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
.
প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি বড় আনন্দের। সেসব কথা আর কী বলব! আমার বইটাতে লিখেছি। আমার চাচা ছিলেন হুমায়ূনের বাবার বন্ধু। তিনি এসে সিলেট থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন। সবাই তো তখন অসম্ভব রকমের খুশি। আমার বাবার ছিল তিন ভাই। প্রত্যেকে আলাদাভাবে মিষ্টি নিয়ে এলেন। খুব খাওয়াদাওয়া, আনন্দ-অনুষ্ঠান হলো। তারপর আমি আবার সিলেটে এলাম। সিলেট থেকে পরে আবার গেলাম বাবার বাড়িতে। সেখানেই হুমায়ূনের জন্ম। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে জন্ম হয় হুমায়ূনের।

. সবাই তখন অসম্ভব রকমের খুশি। আমার বাবার ছিল তিন ভাই। প্রত্যেকে আলাদাভাবে মিষ্টি নিয়ে এলো। খুব খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ অনুষ্ঠান করল।
হুমায়ূনের বাবা পুলিশের চাকরি করতেন। জন্মের এক মাস পরে তার বাবা দেখতে এলেন। সবাই খুব উদ্গ্রীব হয়েছিল। তখন এভাবে কেউ সরাসরি এসে বাচ্চা দেখত না। পরে রাতের বেলা তিনি বললেন, জানো হুমায়ূনের জন্ম আর ইংল্যান্ডের রানির ছেলে চার্লসের জন্ম একই সময়ে। তিনি আবার অ্যাস্ট্রোলজি চর্চা করতেন। তার কথা শুনে আমি হাসলাম। তিনি বললেন, হাসলে কেন? বললাম, কোথায় ইংল্যান্ডের রানির ছেলে আর কোথায় আমার ছেলে।
.
তিনি বললেন, রানির ছেলে তো রানির যোগ্যতায় বড় হবে, আর তোমার ছেলে নিজের যোগ্যতায় বড় হবে। বরাবরই তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তার ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। হুমায়ূন তো বরাবরই পড়াশোনায় ভালো করেছে, যেখানে গিয়েছে সেখানেই ভালো করেছে। ম্যাট্রিক যখন দিল, তখন আমরা তো জানতাম এটা হলো সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। প্রথমবার যে কেউ ফেল করবেই, তার পরের বার গিয়ে পাস করবে। সেই জায়গায় রেডিওতে তার নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন তো টেলিভিশন ছিল না। তখন বাড়িতে আমার ভাইয়ের বিয়ে ছিল। সবাই মহা খুশি। আমার বাবা প্রচুর মিষ্টি আনলেন। এত মিষ্টি আনলেন, একেবারে মিষ্টিময় হয়ে গিয়েছিল বাড়ি। বাড়ির পাশেই থানা ছিল। থানায় মিষ্টি পাঠানো হলো।
.
 আমার বুকের ভেতর নড়েচড়ে গিয়েছিল আমার প্রথম সন্তানের মুখ দেখে। মাথা ভরা চুল, টকটকে ফরসা গায়ের রং, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। তখন বুঝিনি, আমার এই ছেলেই হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তখন বুঝিনি, ছেলে আমার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে! 
.
আমার শ্বশুর আর আমার বাবা মিলে প্রথমে নাম রাখল শামসুর রহমান। পরে, হুমায়ূনের বাবা বললেন, বাচ্চার নাম রাখা হবে হুমায়ূন আহমেদ। আমার শাশুড়ি অবশ্য আমাকে সারাজীবন শামসুর মা বলেই ডেকেছেন।
.
 হুমায়ূনের বাবার খুব মেয়ের শখ ছিল। উনি হুমায়ূনকে প্রায়ই মেয়েদের জামা পরিয়ে রাখতেন। তিনি দীর্ঘদিন হুমায়ূনকে মেয়েদের জামা পরিয়ে রেখেছেন। অনেক ছবিও তুলেছিলেন মেয়েদের জামা পরিয়ে।
.

: তখন আমরা কুমিল্লাতে। ইকবাল ওর বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাসায় গেল, খুব হইচই হচ্ছিল। বিরাট বড় বাসা ছিল। সবাই মিলে একদিন প্ল্যান করল, তারা নকল প্ল্যানচেট করবে, ওদের ভয় দেখাবে। তারপর কী কী যেন করল, নির্দিষ্ট সময়ে মোম নিভে গেল। ইকবাল তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে এর মধ্যে নেই। হঠাৎ রাতের বেলা হুমায়ূন, ইকবালকে না জানিয়ে আব্দুল হক নামের আদরালিকে বলল, তুমি গাছের আগায় একটা দড়ি বাঁধো। দড়ির আরেক মাথা তোমার ঘরের ভেতর রাখবে। রাত যখন আড়াইটা বাজবে, তখন তুমি দুইটা ঝাঁকি দেবে। যখন ঝাঁকি দিল মোমটা নিভে গেল। ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি হলো। ইকবালসহ সবাই ভয়ে অস্থির। তারা ভয়ে আমার ঘরে এসে শুয়ে থাকল। সকাল হতেই সবাই চলে গেল। এখানে আর থাকলই না। হুমায়ূনের আরও অনেক দুষ্টুমি ছিল।
.
হুমায়ূনকে একদিন ধরে নিয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সঙ্গে আরও তিনটা ছেলেকে নিল, একজন শিক্ষককে নিল। হুমায়ূনকে আর্মিরা প্রচুর টর্চার করেছে। অনেক দিন আটকে রেখেছিল। ওকে গুলি করে মেরে ফেলবে, তখন টিচাররা গিয়ে উদ্ধার করল। হুমায়ূন ঘরে ফিরে গিয়ে দেখে, ঘরে তালা দেওয়া।
.
ওই দলটার মধ্যে কেবল হুমায়ূনই বেঁচে ছিল, বাকি সবাইকে গুলি করে মেরেছিল ওরা।
.
ঢাকায় আমার এক মামা ছিলেন, তাঁর বাসায় প্রথম উঠেছিলাম। আবুল হাসিম আমার ভাই। তার বাসায় ছিলাম প্রথমে, তারপর মামার বাসায়। আনিসুর রহমান ঠাকুর নাম। উনি ইনস্যুরেন্সে চাকরি করতেন। হুমায়ূন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত।
.
ওদেরতো বাবা ছিল না। হুমায়ূনই সারাজীবন বাবার ভূমিকা পালন করেছে। পরিবারের সবার কাছে তার গুরুত্ব ছিল অন্যরকম।
.
মোহাম্মদপুরে শহীদ পরিবার হিসেবূ প্রথম বাসা পেয়েছিলাম। একদিন রক্ষীবাহিনী এসে তো খুব হম্বিতম্বি। তারা গাড়ি ভর্তি করে লোক নিয়ে ঢোকে। লুটপাট করে। আমাদের ঘরে এলো। তিন-চারটে ফাঁকা গুলি করল, ঘরের পর্দা, কাপড়চোপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিল। আমার তো জিনিসপত্র তেমন ছিল না। যা ছিল সব ছুড়ে বাইরে ফেলে দিল আর বন্দুক নিয়ে আমার দিকে এলো। ইকবাল আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। পাশের বাসায় মনোয়ার সাহেব ছিলেন। ডা. মনোয়ার হোসেন। তার বাসায় ছিলাম। পরে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি।
.
 আহমদ ছফার সঙ্গে পরিচয় ছিলো হুমায়ূনের। হুমায়ূন, ছফাকে অনেক পছন্দ করত, আবার আহমদ ছফাও হুমায়ূনকে অনেক পছন্দ করতেন। হুমায়ূনের প্রথম বই ‘নন্দিত নরকে’। এই বইটি আহমদ ছফাই অনেক চেষ্টা করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। রক্ষীবাহিনী যখন আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল, তখন আহমদ ছফা এসে আমাকে নিয়ে গেলেন আহমদ শরীফের বাসায়। সেখানে নেওয়ার পরে আহমদ শরীফ সকল ঘটনা শুনে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এরপর ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় আমার অ্যালটমেন্টটি ছাপিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যেই আমি সন্তানদের নিয়ে একটি ভাড়া বাড়িতে উঠে পড়ি। পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর রক্ষীবাহিনীর প্রধান আমাদের প্রতিবেশী ডা. মনোয়ারের বাসায় ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। আমি কথা বলতে রাজি হইনি। আমি চাইনি ওই বাড়িতে উঠে নতুন করে আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে। এরপর রক্ষীবাহিনীর প্রধান আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং বিশেষভাবে অনুরোধ করতে থাকেন। এ সময়টাতে আহমদ ছফা ও ডা. মনোয়ার আমাকে বোঝাতে থাকেন। তারপর আমি মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের এই বাড়িতে আবার বসবাস শুরু করি।
.
আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় আহমদ ছফা প্রেসক্লাবের সামনে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন। আহমদ ছফা অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন।
.
হুমায়ূন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়, রেজাল্ট বের হওয়ার পরদিনই চাকরি হয় ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর চাকরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হুমায়ূনের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির বেতনটা সংসারের জন্য অনেক বড় সহায়ক ছিল। এদিকে কিছুদিন পরেই জাফর ইকবাল স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেল আমেরিকাতে। শাহীনও পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু না কিছু করত। এরপর আর আমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমেরিকা থেকে ওরা দুই ভাই টাকা পাঠাত আর হুমায়ূনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনটাও তুলতাম। তারা তাদের যোগ্যতা দিয়েই এগিয়ে গেছে।
.
ওর স্বপ্ন ছিল এদেশের কেউ আর ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবে না। আমেরিকা থেকে ফিরে এই কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। পারিবারিকভাবেও আর কোনো উদ্যোগের কথা আমি জানি না। তার পর আর কে করবে….।”
.
"ওর সব ব ই ই আমি পড়েছি।   সব প্রকাশকদের এটা বলা ছিল। আমি বই পড়তে পছন্দ করতাম। আগে কলকাতার বই পড়তাম। ছেলে লেখা শুরু করার পর আর পড়িনি।”
.
শেষদিকে আমেরিকা  যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে সবাই ছবি-টবি তুললো। ও বললো, ‘তোমরা কি মনে করেছো আমি মরে যাবো? আমি মরব না। আমি ফিরে আসব। আমি এই দেশে জন্মেছি। বিদেশে মরব কেন? মরতে হয় এই দেশেই মরব’।”
.
ও বলতো, কচ্ছপ দুই-তিনশ বছর বাঁচে। মানুষতো আরো অনেক ভালো ভালো কাজ করে। মানুষ কেন বাঁচবে না। অনেক দিন বাঁচতে হবে। আমি অনেক দিন বাঁচতে চাই।
.
ওর বাবা অনেক দূরে জায়গীর থেকে পড়াশোনা করত। গ্রামে স্কুল নাই। আমি বললাম, আল্লাহতো তোকে সামর্থ্য দিয়েছে, তুই একটা স্কুল করে দে। এরপর ও স্কুল করল। তবে এখনো সরকারি সুযোগ সুবিধা পায় না। শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, এটা করবেন, ওটা করবেন। কিন্তু এখনো হয় নাই।”
.
জীবিত থাকতে আড়াইশ শিক্ষার্থীর এই স্কুলের খরচ হুমায়ূনই চালাতেন। তার মৃত্যুর পর এককালীন একটি অনুদান পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে নুহাশপল্লীর আয় মিলিয়েই চলছে ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’।"
.
আমাদের পরিবারের সবার মাঝেই হৈচৈ রসালাপটা আছে। হুমায়ূনের মাঝে একটু বেশি ছিলো। ও সব সময় হৈচৈ পছন্দ করতো। একা খেতে পারতো না। যখন খাবে খাবার টেবিলে কয়েকজনকে সঙ্গে থাকতেই হবে। একটা ঘটনা বলি, আমি একবার খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। বাসায় ফিরলাম। তখন ও সবার কাছে গল্প করছে আমাকে নিয়ে। 
.
সে বলল, জানো আম্মা হাসপাতালে কি করেছে। আম্মা জ্ঞান ফিরে ভাবতে থাকলেন তিনি বেহেস্তে চলে এসেছেন। তিনি নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি বেহেস্ত। নার্স বলল হ্যাঁ। তখন মা বললেন তাহলে বেহেস্তের আঙ্গুর দেও খাই। তাকে আঙ্গুর দেওয়া হল। তিনি খেলেন। আর খেয়ে বললেন ‘আরে এটা বেহেস্তের আঙ্গুর না। আঙ্গুর ফল টক’। গল্প শুনিয়ে সে সবাইকে হাসালো সেদিন। আমি মাঝে মাঝে কল্পনা করতাম এ ছেলে আমার মৃত্যুর খবর পেলে প্রথমে কাউকে বলবে আমাকে এক কাপ চা দাও। তারপর চা দিলে সে চা খাবে না। আমার লাশের কাছে আসবে না। দূরে দূরে ঘুরে বেড়াবে। একটা সময় কান্না করবে ভাই বোনকে জড়িয়ে ধরে। তারপর সবাইকে বুঝাবে। আর সেই ছেলে আজ আমার আগেই চলে গেল।
.
 হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা!

.
সূত্র- আয়েশা ফয়েজের উপর নেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার।
হিমু চরিত্রটি হয়তো হুমায়ূন নিজেই: মা আয়েশা ফয়েজ/ জব্বার হোসেন।
মায়ের স্মৃতিতে হুমায়ূন/ সুলাইমান নিলয়, আশিক হোসেন। 
হুমায়ূনের পাগলামি তো ভালো ছিল : আয়েশা ফয়েজ

Post a Comment

أحدث أقدم