বাংলার বীর মুক্তি যোদ্ধা কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আগ মূহুর্তে কি ঘটেছিলো জানেন কি?

বাংলার বীর মুক্তি যোদ্ধা কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আগ মূহুর্তে কি ঘটেছিলো জানেন কি?


-রেডিও শহর ডেস্ক
 

রী লুত্ফাকে লেখা শেষ চিঠিতে তাহের বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে।’


যখন  শেষ  ইচ্ছে আছে কিনা তাহেরের  জানতে চাওয়া হলো তখন তিনি বললেন,   ‘আমার মৃত্যুর বদলে আমি সাধারণ মানুষের শান্তি কামনা করছি।’ এরপর ফাঁসির মঞ্চে আবৃত্তি করেন সেই অমর কবিতাখানি- 

.

“জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে, কাঁপিয়ে দিলাম।

জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙব বলে, ভেঙে দিলাম।

জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে, করেই গেলাম

জন্ম আর মৃত্যুর বিশাল পাথর রেখে গেলাম

পাথরের নিচে, শোষক আর শাসকের কবর দিলাম

পৃথিবী, অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।”

.

উনি সেই কর্নেল তাহের তিনি  পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসেবে পেয়েছিলেন ''মেরুন প্যারাস্যুট উইং'  সম্মাননা। 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে  শ্রেষ্ঠ  কমান্ডারদের মধ্যে অন্যতম

 অনেকের চোখে সর্বশ্রেষ্ঠ কমান্ডার। যার অধীনে ছিলো ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব। 

  .

 জামালপুরের  বক্সীগঞ্জ উপজেলার  কামালপুর ছিলো পাকিস্তানি হানাদারদের  শক্তিশালী বিওপি। আগেও ওখানে বেশ কয়েকটা অপারেশন হয়। সবগুলো ছিল অসফল। কিন্তু এবারের অপারেশনটা ছিলো ভিন্ন রকমের। তাঁদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলো ভারতের মারাঠা রেজিমেন্ট, গোর্খা রেজিমেন্ট আর গার্ড রেজিমেন্ট। সবগুলোর কমান্ডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। সিদ্ধান্ত হয়েছিলো‌ নেতৃত্ব দিবেন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের। 

.

১৩ নভেম্বর, ১৯৭১। 

দুপুরে  আবু তাহের তাঁর অধীনস্থ কমান্ডারদের  নিয়ে আলোচনায় বসলেন। ঠিক  হলো এদিন রাত ১২টার কামালপুর আক্রমণ  করা হবে। ১৪ই নভেম্বর ছিল তাহেরের জন্মদিনও।  আগেই ঠিক করা ছিল  কর্নেল তাহেরের কোড হবে ‘কর্তা’। যে কেউ তাঁর সঙ্গে  যোগাযোগ করলে ‘কর্তা’ নামে সম্বোধন করবে। ১৩ই নভেম্বর  রাত ১১টায় রওনা হলেন সবাই। কামালপুরের আগেই বানরোড। তারও পেছনে তাহেরের কমান্ড পোস্ট। সেখানেই অবস্থান  নিলেন কেউ কেউ। পাশেই ব্রিগেডিয়ার  ক্লেয়ার, গোর্খা রেজিমেন্টে কর্নেল বারাখ, মারাঠা রেজিমেন্টের কর্নেল বুলবুল ও গার্টস রেজিমেন্টের  বারাট। 

.

ঠিক করা হলো  আর্টিলারি ফায়ারের পর শুরু হবে অপারেশন। রাত তখন ১২টা।  মুহুর্মূহু শেল পড়ছে  কামালপুর বিওপির উপরে। কর্নেল তাহেরের নির্দেশে  প্রায় সাড়ে তিন হাজার আর্টিলারি নিক্ষেপ করা হয়েছিলো।  উপরে আলোর ঝলকানি। পাকিস্তানি সেনারা একটানা গুলিবর্ষণ করছে এদিকে।  নির্দেশ ছিলো মুক্তিযোদ্ধারা চার্জ করবে ‘জয় বাংলা’ বলে। কিছুক্ষণ পর চারপাশ থেকে ‘জয় বাংলা’র চিৎকার। কর্নেল তাহেরের কাছে ছিল  একটি  ওয়াকিটকি। সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট মিজান হঠাৎই বললেন  ‘কর্তা আমরা পাকিস্তানিদের প্রথম লাইনের বাঙ্কার দখল করে নিয়েছি।’ তখন আনন্দে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুললেন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে।

.

রাত তখন তিনটার মতো মিজানের সঙ্গে  তাহেরের যোগাযোগ হচ্ছে না। ওয়াকিটকিতে তাহের বার বার জিজ্ঞেস করছেন,  ‘মিজান, তুমি কোথায়?’  ওপাশে কোনো সাড়া নেই। তিনি চিন্তিত হয়ে গেলেন। এদিকে  ভোর হয়ে আসছে। হঠাৎ কর্নেল  তাহের কমান্ড পোস্ট থেকে উঠে  ব্রিগেডিয়ার  ক্লেয়ারকে বললেন ‘আমি ফ্রন্টে যাব।’ ক্লেয়ার  অবাক হয়ে বলেন, ‘কেন!’ জবাবে তাহের বললেন, 'আমি আমার ছেলেদের দেখতে চাই।’  শেলের আঘাতে পাকিস্তানিদের বাঙ্কারগুলো ভেঙে গেছে এরই মধ্যে । পাকিস্তানী সেনারা বেরিয়ে আখক্ষেতে লুকোচ্ছে। 

.

 তাহের পজিশন নিয়ে নিয়ে এগোলেন।  বান সড়কের ঢালে এসে বসলেন দুই পা ভাঁজ করে। এক পাশে তাঁর ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল অন্যপাশে তাহেরের আরেক ভাই শাখাওয়াত হোসেন বাহার, পেছনে তিন-চারজন পজিশনে।  তাহের কলফ স্টিক দিয়ে পাকিস্তানিদের দেখালেই, ওদিকে গুলি করছেন বেলাল। এরমধ্যেই হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো।  বেলাল খেয়াল করলেন  তাহের বেলালের ওপর পড়ে যাচ্ছেন। তাহের দেখলেন তাঁর বাঁ পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন প্রকার ঝুলে আছে।‌এদিকে দূর থেকে পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করছে। ওরা বুঝে গিয়েছিলো কমান্ডার ধরনের  কেউ শেলের আঘাতে আহত হয়েছে। এদিকে কর্নেল তাহের নিস্তেজ গেছেন। বানের জলের মতো‌ রক্ত ঝরছে। হঠাৎই তাহেরের ভাই ওয়ারেসাত হোসেন  বেলাল হুট করে ভুল বুঝে ওয়াকিটকিতে বলে ফেললেন, ‘কর্তা ইজ ডেড।'

.

পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। কর্নেল  তাহেরের এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা একটা কুঁড়েঘরের দরজা ভেঙে নিয়ে এলেন। সেখানে আবু তাহেরকে তুলে নেয়া হলো। কিন্তু এভাবে তো বেশি দূরে নেওয়া যাবে না। এরপর  বেশ দূরে দৌড়ে গিয়ে বেলাল ভারতীয় বাহিনীর একটি  জিপ এনে  তুলে নিলেন। আবু তাহেরের তখনো মনোবল ভাঙ্গেনি। এরইমধ্যেই   আনোয়ার দৌড়ে চলে আসলেন। তাঁকে দেখেই তাহের বললেন, ‘দেখো আমার মাথায় ওরা আঘাত  করতে পারে নাই। তোমরা কামালপুর মুক্ত করবে। আমি ফিরে এসে যেন দেখি কামালপুর মুক্ত হয়েছে।’ এরপরই  চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে কর্নেল  তাহেরকে প্রথমে তুরা এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য  নিয়ে যাওয়া হয় গৌহাটিতে। 

.

মুক্তিযুদ্ধে এই কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধার অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁর সব ভাইবোনেরা। তাহের ছাড়াও তাঁর ভাই আবু ইউসুফ পেয়েছেন বীরবিক্রম খেতাব। ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল এবং শাখাওয়াত হোসেন বাহার পেয়েছিলেন বীর প্রতীক খেতাব। তাঁদের ভাই-বোনদের এই দলটিকে 'ব্রাদার্স প্লাটুন' নামে ডাকা হতো। 

.

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ কমান্ডারকে ১৯৭৬ সালের  আজকের দিনে  মেজর জিয়ার নির্দেশে এক মিথ্যা, প্রহসন  ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফাঁসিতে  ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছিলো। যার সঙ্গে মুছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো তাঁর দুর্ধর্ষ আর অমর বীরত্বগাঁথা।  মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে পা হারানো একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁরই মুক্ত করা স্বদেশভূমিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো। এরচেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে! 

 কর্নেল তাহের হত্যা দিবসে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ  করি জাতির ইতিহাসের‌ এই শ্রেষ্ঠ  সন্তানকে। এই বাংলাদেশ  যতোদিন থাকবে ততোদিন আপনি অবিস্মরণীয়  হয়ে থাকবেন ক্র্যাচের কর্নেল। 


ডেস্ক রিপোর্ট 

Post a Comment

Previous Post Next Post