-রেডিও শহর ডেস্ক
দোকানে ফল বিক্রির জন্য বসেছিলেন ইউসুফ খান, আর সেই দোকানে ফল কিনতে গিয়েছিলেন একজন। তিনি ‘ফলের দোকানদার’ ইউসুফ খানের মাঝে এমন কি দেখলেন যে, তাকে অভিনয়ে নিয়ে আসলেন, নায়ক বানালেন!
ভাগ্যিস, ইউসুফ খান ফলের দোকানে বসেছিলেন সেদিন, ফল ক্রেতা দেখে ফেলেছিলেন তাকে, নায়ক বানিয়েছিলেন নিজের বিচক্ষণতায়। তাই তো আমরা উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ‘দিলীপ কুমার’কে পেয়েছিলাম, যার নাম নাম শুনলেই আলগোছে সবাই উঠে দাঁড়ান নিজের আসন থেকে---সম্মানে, বিনয়ে, অনুনয়ে।
*
চিকনা শরীর, চিকনা পা আর ঢ্যাংঢ্যাং অবয়বের ছেলেটিকে প্রথম দেখায় পছন্দ করেননি কেউ। সে আবার হবে নায়ক! তবুও একদিন হলো। পরপর বেশ কয়েকটা ছবি ফ্লপও হলো তার।
তারপর?’
তারপর তো ইতিহাস।
আরো একজন ‘অমিতাভ বচ্চন’ আসতে বলিউডে অন্তত ১০০ বছর লাগবে। সেই টিংটংয়া ছেলেটার প্রেমে পড়েছিল ওই সময়ের তাবত নায়িকা এবং অন্যরা। আর অমিতাভ শুধু নিজে অভিনয় করেন না, তার হাত অভিনয় করে, পা অভিনয় করে, নাক-কান-চোখ অভিনয় করে।
এমনকি তার ছায়াও!
*
পুরোদস্তর একজন বাসের কন্ডাক্টর ছিলেন তিনি। আর আজ তার নামে মন্দির তৈরি হয়, তাকে নিয়ে পুজা-অর্চনা হয়, তাকে দেশের প্রধান হিসেবে দেখতে চায় অনেকে।
তাই তো, তাই তো একজন ‘রজনীকান্ত’ ৬৪ বছরেও ৪২ বছরের ঐশ^রিয়া রায়ের নায়ক হন মহা দাপটে। অভিনয়ের স্টাইল, কথা বলার ঢং আর টুকরো টুকরো ক্যারিশমা, তাকে এই ৭০ বছরেও এক নম্বরে রেখেছে। যতই হাজার কোটির যশ, আল্লু অর্জুন, প্রভাস আসুক; রজনীকান্ত’র কাছে তারা এখনো কমা (,) সেমিকোলনের (;) মতো!
অথবা চিড়িয়াখানার সিংহের খাঁচা পরিস্কারক সিলভার স্ট্যালোন, পরবর্তীতে ‘রকি’, ‘র্যামবো’র চিরন্তন নায়ক, আর বরাবর রোবটের মতো কথা বলা, অল্প-স্বল্প অভিনয় জানা, পেশী-শরীর নির্ভর আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার যে ‘টার্মিনেটর-২’ ছবিটা করেছেন, এতেই তিনি বেঁচে থাকবেন অন্তত কয়েক যুগ!
ঘটনা আছে আরো একটা---বরিস জনসনের পতনের পর ব্রিটেনের তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, সেই নারী নৌসেনা পেনি মরড্যান্ট রাজনীতিতে আসার আগে জাদুকরের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।
এবং আমাদের অনন্ত জলিল...
ফল বিক্রেতা নন আমাদের অনন্ত জলিল, টিংটংয়া শরীরের মানুষও নন তিনি, সমাজের ‘নিম্ন কাজের’ তালিকায় থাকা বাস কন্ডাক্টরও ছিলেন না কখনো।
চিড়িয়াখানা পরিস্কারক কিংবা শরীর নির্ভর রোবটিয় মানুষ নন তিনি।
অনন্ত জলিল একজন শিক্ষিতজন, সফল ব্যবসায়ী. মানবিক মানুষ, সর্বোপরি একজন সংস্কৃত বহন করা আত্মা। তার অনেক টাকা আছে, কিন্তু আমাজনের জেফ বেজোসের মতো হাজার কোটি খরচ করে মহাকাশ ভ্রমণে যেতে চাননি। তাজমহলের কাছাকাছি একটা প্রেম-সৌধ বা প্রাসাদ বানানোর সামর্থ্য আছে অনন্ত জলিলের, তিনি সেরকম একটা বানিয়ে চির স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন এবং টিকেটের মাধ্যমে তা দেখানোর ব্যবস্থা করে বছরে বহুত টাকা রোজগার করতে পারতেন। অনন্ত জলিলের যা অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে তিনি বিশাল একটা প্রমোদ তরী বানিয়ে, সেই প্রমোদ তরীতে বিভিন্ন ‘পানাহার’-এর ব্যবস্থা করে, দেশের বিভিন্ন ‘সংস্কৃতির ধারক ও বাহক’কে দাওয়াত দিতে পারবেন, যারা পরবর্তীতে গুণকীর্তণের ফেনা তুলতেন মুখের ‘পানের পানি’র ফোয়ারায়। কিংবা নিজেদের অপকর্ম ঢাকার ঢাল হিসেবে ইদানীং যে অবৈধ ধনকুবেররা একটা করে ‘দৈনিক পত্রিকা’ বের করার প্রয়াস চালাচ্ছেন, অনন্ত জলিল সেটাও করেননি। অথবা সাধারণ মানুষের জায়গা দখল করে কোনো আবাসন প্রকল্পও বানাননি শান-শওকতে। কিংবা দেশের সংস্কৃতি বেচে, টাকার পাহাড় গড়ে, মার্কিন মূলকে পাড়ি জমানোরও চেষ্টা করেননি ইদানীং।
অনন্ত জলিল কী করেছেন---নিজের টাকা খরচ করে সিনেমা বানিয়েছেন এবং সেই সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এবং সেই ছবি দিয়ে আমাদের দেশের মরে যাওয়া শোবিজে অন্যরকম এক আমেজ ও আন্তর্জাতিক ছোঁয়া দিয়েছেন।
উচ্চারণ ত্রুটি কার নেই? কে জন্মেই ভালো অভিনেতা হয়ে আসে? ধীরে ধীরে পরিচর্চা আর পরিশীলন করেই একজন মানুষ বড় হয়, বড় হতে হয় তাকে।
আর সেই বড় হওয়াতে সাহায্য করতে হয় আমাদের---অনুপ্রেরণা দিয়ে, ধন্যবাদ দিয়ে, নিজের ‘থাম্বস আপ’ দিয়ে, আলোচনা-পর্যালোচনা দিয়ে।
এবং শেষ কথা
ফরীদি ভাইয়ের সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সাক্ষাতকার দিতে চাননি তিনি সহসা। খুব কষ্ট করে তিনটি সাক্ষাকারও নিয়েছিলাম তার।
ক্ষণজন্মা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই অভিনেতা একসময় আজাদ প্রোডাক্টসে চাকরি করতেন।
হাতের দু ফাঁকের আঙ্গুলে দগদগে সিগারেট, দু পা গুটিয়ে আসনে বসা, সামনের দেয়ালে শিশির ভট্টাচাযের্র আঁকা নিজের প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে ফরীদি ভাই বলেছিলেন, ‘আমি চুরি করতে পারি না, রাজনীতি জানি না, কেবল পারি একটু অভিনয়। এটা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই, মরে যেতে চাই। হা হা হা...।’
মনের সমস্ত ক্লেদ আর গুমোট বাতাস বের করা সেই হাসিতে আমি স্বর্গের ছোঁয়া দেখেছিলাম ফরীদি ভাইয়ের মুখে, চেহারায়। না হলে, তার চোখ দুটো এতো উজ্জল ছিল কেন সেদিন, ঠোঁট দুটো এতো প্রাণবন্ত!
অনন্ত জলিল, আপনি হাসুন---কারণ আপনি জিততে আসেননি, মানুষকে জেতানোর স্বপ্ন দেখাতে এসেছেন।
এবং শেষ পর্যন্ত আপনি জিতবেন। বারো মাসে তের যন্ত্রণায় ভোগা অভাগা এই দেশের এই সাধারণ এই আমরা মানুষরা যে বুঝ-অবুঝের ফারাক বুঝি না, ভালো-মন্দ হারিয়ে ফেলেছি সেই কবেই, লজ্জা পাই ভালোবাসা দিতেও।
ভুলে গেছি আমরা মর্যাদা দিতে, এবং পেতেও।
#sumanto_aslam
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন