-রেডিও শহর ডেস্ক
ঠাকুরবাড়ির আধুনিকা।
কাদম্বরী- নামের বাংলা অর্থ-
১ সরস্বতী।
২ কোকিলা।
৩ উজ্জ্বল।
কাদম্বরী দেবীর জন্ম - ১৮৫৯সালের ৫জুলাই।
কাদম্বরী দেবী কলকাতার মেয়ে। তাঁর বাবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ ছিল অনেকদিন থেকেই। তাঁর আদি বাড়ি ছিলো খুলনার দক্ষিণ ডিহি গ্রামে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাথে দীর্ঘকাল ধরেই দক্ষিণডিহি গ্রামের সম্পর্ক। বংশ পরম্পরায় রবীন্দ্রনাথের ঠাকুমা দিগম্বরী দেবী, কাকীমা ত্রিপুরা সুন্দরী দেবী, মা সারদা সুন্দরী দেবী, বউদি কাদম্বরী দেবী এবং বউ মৃণালিনী দেবী সবাই এই গাঁয়েরই মেয়ে। কাদম্বরী দেবীর বাড়ি ছিলো গ্রামের মঠবাড়ি এলাকায়।
১৮৬৮ সালের ৫ই জুলাই কাদম্বিনীর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় কাদম্বিনী ছিলেন নিরক্ষরা বা অনেকের মতে তাঁর সামান্য অক্ষরজ্ঞান ছিলো।
১৮৭০ সালের শ্রাবণ সংখ্যার তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল—
“গত ২৩ আষাঢ়, শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পঞ্চমপুত্র শ্রীমান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত কলিকাতা নিবাসী শ্রীযুক্তবাবু শ্যামলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যার যথাবিধি ব্রাহ্মধর্মের পদ্ধতি অনুসারে শুভবিবাহ সমারোহপূর্বক সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে।
দরিদ্রদিগকে প্রচুর তক্ষ্যভোজে পরিতৃপ্ত করিয়া বিস্তর অর্থ প্রদান করাও হইয়াছিল।”
দেবেন্দ্রনাথের ছোট ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম ছিল কাদম্বিনী। সেই জন্যেই কাদম্বিনীর নাম পালটে করা হল 'কাদম্বরী' ।
কিঞ্চিত শ্যামবর্ণা হলেও সুন্দরী ছিলেন তিনি। তার চুল এবং চোখের প্রশংসা তখন সবাই করত। জ্ঞানদানন্দিনী বলেছেন, "আমরা বউয়েরা প্রায় সকলেই শ্যামবর্ণ ছিলুম। শাশুড়ি ননদ সকলেই গৌর বর্ণা ছিলেন।"
বিয়ের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন গণেন্দ্রনাথ। বেশ সমারােহ করেই এই বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও বিয়ে হয়েছিল হিন্দু প্রথায়। এ' উপলক্ষ্যেবাড়ির সব ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় জুতাে কিনে দেওয়া হয়েছিল।
বিদ্যাচর্চা শুরু হল একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে।
কাদম্বরী বউ হয়ে যে বছর প্রবেশ করেন, ঠাকুরবাড়ির সে বছরের হিসেবের খাতা থেকে জানা যায়, কাদম্বরীর জন্য "বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ" কেনা হয়েছিল।
তারপর কাদম্বরী নেশা হয়ে উঠলো বই পড়া- নিছক সময় কাটাবার জন্য তিনি বই পড়তেন না। বই পড়ে সেগুলোকে উপভোগ করতেন-ভাবতেন।
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের যা কিছু সুন্দর, তার সাথে জড়িয়ে গেলেন কাদম্বরী।
তিনতলার ছাদে গড়ে তুললেন “নন্দন কানন”। পিল্পের উপর বসানো হল সারি সারি পাম, চামেলী, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা ফুলের গাছ। এল হরেক রকম পাখি।
সেখানে সন্ধেবেলায় বসত গান ও সাহিত্যপাঠের পরিপাটি আসর। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রূপোর রেকাবে ভিজে রুমালের ওপর বেলফুলের গোড়ের মালা, এক গ্লাস বরফজল, বাটা ভর্তি ছাঁচি পান সাজানো থাকত। কাদম্বরী গা ধুয়ে, চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন সেখানে। জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্র ধরতেন চড়া সুরের গান। বাড়ির অনেকে যোগ দিতেন সে আসরে। বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী, জানকীনাথ, মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল।
দেখতে দেখতে ঠাকুরবাড়ির চেহারা পালটে দিলেন কাদম্বরী এবং নিজেকেও - কাদম্বরী।তিনতলায় এল পিয়ানো।ঘোড়ায় চড়া শিখে গঙ্গার ধারে গড়ের মাঠে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন।
একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে মাটির উঠোনে জ্যোতিরিন্দ্রের লেখা প্রহসন “এমন কর্ম আর না, পরে 'বসন্ত উৎসব' এবং 'মানময়ী' নাটকেও কাদম্বরী বেশ ভাল অভিনয় করেন।
কাদম্বরীর মধ্যে ছিল এক চিরন্তন মাতৃহৃদয়। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে দেখাশোনা করতেন। কারো জ্বর হলে শিয়রে কাদম্বরী, বাচ্চাদের কিছু সমস্যা হলে সাথে সাথে ছুটলেন কাদম্বরী।
তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। তিনি স্বস্তি পেতেন নিজের মনে একা একা থেকে- নিজের কল্পনার আকাশে। রাজ্যের বই তার সঙ্গী ছিল একাকীত্বের। দীর্ঘাঙ্গী,গাঢ় ভ্রূ, বড় বড় অক্ষিপল্লব, কৌতুকময় চোখ, পরিমিত বেশভূষা, কথা বলার ভঙ্গী সবকিছু নীরবে জানান দিত তার ব্যক্তিত্বের মহিমা। জাঁকজমকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মতন না, তার সৌন্দর্য ছিল গ্রীক দেবীর মতন। স্বল্পভাষী, রহস্যময়ী, প্রচণ্ড অভিমানী- জেদী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মায়ের স্নেহপরায়ণা, বালিকার মত উচ্ছল স্বভাবের। কঠিন কোমলের অপূর্ব সমন্বয় এই নারী,কিছুটা নিজের মধ্যে গুটানো এক মানুষী। শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে তিনি ছিলেন দেমাগী, মিশতে পারে না একদমই। এর উপর ছিলেন নিঃসন্তান। রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে ঊর্মিলা ছিল কাদম্বরীর ভারী ন্যাওটা। পরে ঊর্মিলা যখন মারা গেল, আত্মীয়স্বজন, ঝি-ঠাকুর সবাই কানাঘুষা করা শুরু করল কাদম্বরী হল আঁটকুড়ি, হিংসা করে খেয়ে ফেলেছে।
১৮৮২ পুজার ছুটির সময় জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উৎসাহী হয়ে বাস্তভিটা দেখবার অযুহাতে যশোরের নরেন্দ্রপুর ও যান। জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে কাদম্বরী আসেন দক্ষিণ ডিহিতে ভিটা দেখতে। এরপর অবশ্য সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে।
কাদম্বরীর মতো সুরসিকা, রুচিশীলা, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনে শান্তির অভাব ঘটতে থাকল।
আর তাই হয়তো কথায় আছে?
"অতি বড় ঘরনি না পায় ঘর,
অতি বড় সুন্দরী না পায় বর।"- ঘর এবং বর দুই'ই পেয়েও তাঁর সংসার আর জীবন অবেলায় ফুরিয়ে যায়।
সরস্বতী বা কোকিলা,কোনো অর্থই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নি।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে -
“কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিণাম।
সৌজন্যে বাদুস পরিবার
ডেস্ক রিপোর্ট
إرسال تعليق