-রেডিও শহর ডেস্ক
আমাদের একজন মাজহারুল ইসলাম ছিলেন। আমাদের এক আলোকদিশারী পথিকৃৎ স্থপতি ছিলেন।
.
যে মাজহারুল ইসলাম বলতেন, 'স্থাপত্য মানে কেবলই কাঠখোট্টা আর ইট পাথরের দেয়াল না। ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে স্থাপত্য একই সঙ্গে আধুনিকতা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটাবে। নিজের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটবে সেখানে স্থাপত্য তো প্রকৃতির বাইরে নয়। আমি পড়েছি যুক্তরাষ্ট্রে তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপত্য তো এই দেশের মাটিতে হবেনা। এদেশের জল,হাওয়া, মাটিতেই গড়ে উঠবে এদেশীয় স্থাপত্যের বিকাশ।'
.
যে মাজহারুল ইসলাম চাইলেই থেকে যেতে পারতেন উন্নত বিশ্বে আরাম আয়েশে আর বিলাসিতায়। কিন্তু তা তিনি কোনদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। তিনি আপন হাতে গড়ে তুলেছেন এদেশের স্থাপত্য শিল্পকে।
.
জাতীয় সংসদ ভবন প্রজেক্টে স্থপতি হিসেবে থাকলেও একটা পয়সাও পারিশ্রমিক নেননি মাজহারুল ইসলাম। সরকার থেকে যখন তাঁর পারিশ্রমিকের কথা উঠেছিলো তিনি বলেছিলেন 'এটি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় কাজ। আমি এখান থেকে কোনো অর্থ নিতে চাই না।'
.
বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানকে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন মাজহারুল ইসলামই। লুই আই কান নকশা করলেন জাতীয় সংসদ ভবন ও কমপ্লেক্সের। পরবর্তীতে লুই আই কানকে দিয়ে বর্তমানের গোটা শেরেবাংলা নগর এলাকার ডিজাইন, বিশ্বখ্যাত স্থপতি পল রুডলফকে দিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করিয়েছিলেন মাজহারুল ইসলাম।
.
১৯৫৬ সালে বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে পড়তে গিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করেছিলেন পল রুডল্ফ-এর অধীনেই। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ পল রুডলফের। পড়াশোনা শেষে যে ফার্মে তিনি ঢুকেছিলেন সেখানে ছিলো মোটা অংকের মাইনে, থাকার জন্য বিলাসবহুল বাংলো বাড়ি। অথচ দেশের টানে তিনি ফিরে এলেন। কেন দেশে ফিরলেন এই কথার জবাবে বলেছিলেন, 'সবাই বললো থেকে যেতে। কিন্তু ঐ যে দেশের টান। খেয়ে পরে থাকতে পারলেই আমার হবে। অতো টাকা দিয়ে তো আর সুখ হয় না! আমি সবসময়ই বলি দেশের ছেলেরা পড়তে, শিখতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে যাকে। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ শেষে যেন দেশে ফিরে আছে। তাদের প্রতি তো দেশের মানুষের ও কিছু দাবী ও প্রত্যাশা আছে।
.
পঞ্চাশের দশকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে স্থাপত্যে পড়তে গিয়েছিলেন মাজহারুল ইসলাম তখন অরিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মিস্টার রস ও ডিজাইনের অধ্যাপক অধ্যাপক হেইডেনকে।
.
এই দুই শিক্ষকের একটি কথা আজীবন স্মরণ করেতেন মাজহারুল ইসলাম। দুজনই তাঁকে বলেছিলেন, 'তুমি যে পড়াশোনা করতে এসেছো, এখানে আসলে ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের আলোচনাও পড়াশোনা হবে। কিন্তু যেহেতু তুমি ভারতবর্ষের ওই অঞ্চল থেকে এসেছো, মনে রাখবে তোমাদের ওখানকার সংস্কৃতিও বহু পুরনো এবং ভীষণ গর্বের জিনিস। এখানে কিন্তু তা শেখানো হয় না। কিন্তু তোমাকে নিজের চেষ্টায় শিখে নিতে হবে।'
.
সে চেষ্টা আজীবনই ছিলো মাজহারুল ইসলামের মধ্যে। যার প্রমাণ আমরা পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট দেখে। তখন ছিলো আর্ট কলেজ। সেই নকশার ডিজাইন মাজহারুল ইসলামের আপন হাতে নির্মিত।
আর্ট কলেজ বা বর্তমানের চারুকলা ইনস্টিটিউট নির্মানের সময়ের মেয়াদ খুবই কম ছিলো। কার সরকারের তিন চারটা কাজ দীর্ঘ তিন চার বছর ধরে পড়েছিলো। তাঁকে যখন দায়িত্ব দেয়া হলো তখন প্রজেক্টের মেয়াদ আর কয়েক মাস মাত্র বাকি। এই প্রজেক্ট চলে গেলে আর বরাদ্দ ও পাবেনা আর্ট কলেজ।
আর্ট কলেজ আর ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি ডিজাইনের দায়িত্ব দেয়া হলো তাঁকে। তখন কেউ নেই তাঁর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে। একাই কাজ শুরু করলেন মাজহারুল ইসলাম।
.
কাজ আরম্ভের সময় দুটো জিনিস তার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি হলো উপাদান অর্থাৎ ম্যাটেরিয়ালস।
তখন ঢাকাতে ভালো ইট তৈরি হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও কয়লা দিয়ে পোড়ানো সেই ইটে এক সময় ফাঙ্গাস পড়তো। সেসময় গ্যাস দিয়ে পুড়িয়ে কিছু ইট বানানো হতো। যা ৫ শতাংশের বেশি পানি শোষণ করতে না পারে। তখন মাজহারুল ইসলাম নিজে ইটগুলো তৈরি করতে বললেন যার উপর ভিত্তি করে এই আর্ট কলেজ গড়া হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সবচেয়ে দারুণ দিক হলো এখানে বায়ু, রোদ ছায়ার কী অপূর্ব মিশেল, আবার একই সঙ্গে একসাথে না মিলিয়ে ছাড়া ছাড়া বাড়ি, অনেকটা খোলামেলা রাখা। যেখানে মাজহারুল ইসলাম বাঙালি সংস্কৃতি ও আবহাওয়াকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিও তাই। নিপা ভবন ও তাঁর হাতে গড়া। আজো নিপা ভবনের দেয়ালে আলো ছায়ার মেলবন্ধন দেখলে মুগ্ধ হতে হয়।
.
বর্তমানে দেশের সবচেয়ে সুন্দর দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম, দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানই করেছিলেন মাজহারুল ইসলাম। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে তিনি প্রকৃতির মেলবন্ধনের সঙ্গে স্থাপত্যকলার নিপুণ ব্যবহারে যে প্রাণ দিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য। রাঙ্গামাটির এখন যে আধুনিক শহর তাও তাঁর নকশায় তৈরি।
.
বিশ্বখ্যাত স্থপতি স্ট্যানলি টাইগারম্যানকে সাথে নিয়ে রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশালের জন্য মোট পাঁচটি পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের ভবনগুলোর ও ডিজাইন করেছেন তিনি। এই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোই বর্তমানে দেশের সবচেয়ে সুন্দর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
.
সারাজীবন বলতেন, 'শুধু স্থাপত্যে আধুনিকতা আনলে হবেনা। মন মানসিকতায় আধুনিকতা এবং তার সঙ্গে স্থান কাল পাত্রে একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। একটি হবে সেটি যেটি সারা বিশ্বের আধুনিকতার সঙ্গে জড়িত হবে। অন্যটি হবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। যা মাটি বায়ু জল এর সাথে সবসময় সম্পর্কিত থাকবে। আমরা যদি নিজেদের সংস্কৃতিকেই স্থাপত্যে তুলে না আনতে পারি তবে তা ভীষণ দুর্ভাগ্যের।'
.
নিজের সংস্কৃতি আর মাটির প্রতি তাঁর মতো ভালোবাসা বিরল। কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন একবার বলেছিলেন, 'মাজহারুল ইসলামের কাজের ভিতরে বাঙালিয়ানার প্রতি তীব্র এক আবেগ ছিল। যা তিনি আজীবন আঁকড়ে ধরেছিলেন।' এই যে সরলতা আর বাঙালিয়ানার আভিজাত্য তা অনন্য করে তুলেছিলো মাজহারুল ইসলামকে।
.
আজ তার প্রয়াণ দিবস....
সৌজন্যে বাদুস পরিবার
ডেস্ক রিপোর্ট
Post a Comment