//আহম্মদ ছফা বাংলা সাহিত্যের রাজ পুত্র//

//আহম্মদ ছফা বাংলা সাহিত্যের রাজ পুত্র//


-রেডিও শহর ডেস্ক
 

আহমদ ছফা : বিস্ময়কর এক নক্ষত্রের নাম

নূরুল আ‌নোয়ার


একজন মানু‌ষের জীব‌নে বহু রকম ঘটনা ঘ‌টে, তার ম‌ধ্যে দুুটি ঘটনা‌ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ জন্ম নি‌য়ে পৃথিবী‌তে আ‌সে, তারপর মৃত্যুর মধ্য দি‌য়ে পৃ‌থিবী থে‌কে বিদায় নেয়। এ দু‌টি ঘটনা চিরন্তন। এ দু‌টি ঘটনা শুধু মানু‌ষের বেলায় ঘ‌টে তা নয়, পৃ‌থিবীর তাবৎ প্রা‌ণি গাছপালা এমন কি বস্তুর ক্ষে‌ত্রেও ঘটে চ‌লে‌ছে এবং ঘট‌তে বাধ্য। যার সৃ‌ষ্টি আ‌ছে তার ধ্বংসও আ‌ছে।

মানুষ সু‌খে হা‌সে দুঃ‌খে কাঁ‌দে। মানবসন্তান সন্তান যখন ভূমিষ্ট হ‌য় তখন সে কান্না দি‌য়ে জানান দেয়, পৃথিবী‌তে তার আগমন ঘ‌টে‌ছে। এই আসার সং‌কেত পে‌য়ে প্রসব‌বেদনায় কাতর মা সব কষ্ট ভু‌লে গি‌য়ে হা‌সি মু‌খে সন্তান‌কে বু‌কে তু‌লে নেয়, পাশাপাশি অন্যরাও সে আন‌ন্দের ভাগীদার হয়। এ অানন্দ‌কে পুঁ‌জি ক‌রে জন্ম নেয়া মানবসন্তান ধী‌রে ধী‌রে অ‌নেক কিছু ঘটি‌য়ে চ‌লে। যেসব ঘটনা সে ঘটায় তার আবার দু রকম ‌দিক আ‌ছে, এক‌টি ই‌তিবাচক, অপর‌টি নেতিবাচক, অর্থাৎ ভা‌লো এবং মন্দ। যে যেটাই ঘ‌টি‌য়ে তুলুক, দু‌টোই বিষয়ই সম্ভাবিত হয় সে জন্ম নেয় ব‌লে। সুতরাং পৃ‌থিবী‌তে জন্ম নেয়াটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন্ম নি‌য়ে সে পৃ‌থিবী‌তে একটা ই‌তিহাস তৈরি ক‌রে, কারওটা ম‌নে রাখার ম‌তো কারওটা ম‌নে রাখার ম‌তো হ‌য়ে ও‌ঠে না। পৃ‌থিবী‌তে কো‌টি কো‌টি মানুষ এ‌সে‌ছে, আবার তারা প্রকৃ‌তির নিয়মে চ‌লেও গে‌ছে। এত মানুষ এ‌ল গেল, কিন্তু খুব কম মানুষই‌ ভাগ্য নি‌য়ে জ‌ন্মে‌ছে যা‌দের নাম পৃ‌থিবী‌তে সম্মানের স‌ঙ্গে হোক আর অসম্মানের স‌ঙ্গে অদ্যাব‌ধি টি‌কে আ‌ছে। এই টি‌কে থাকা মানুষগু‌লোই হ‌ল ই‌তিহা‌সের নায়ক। তাহ‌লে কি বাকিরা কি ইতিহা‌সের চরিত্র ছিল না? ছিল, কিন্তু মানুষ তা‌দের ম‌নে রা‌খেনি। সুতরাং মানু‌ষের চ‌লে যাওয়াটা আমার কা‌ছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় নয়। চ‌লে যাওয়া মানু‌ষের কোন দাম নেই। ত‌বে সে যে কিছু কাজ কিংবা কিছু কা‌জের গ‌তি রে‌খে যায় তার জন্য মানুষ অদৃশ্যভা‌বে বেঁ‌চে থা‌কে। এজন্য মানুষ তা‌কে স্মরণ ক‌রে। এ অদৃশ্যভা‌বে বেঁ‌চে থাকা এবং তার জীবন ও কাজ‌কে স্মরণ করা সে‌টি মৃত মানু‌ষের জ‌ন্মেরই ফল। জ‌ন্ম মা‌নে আনন্দ, মৃত্যু সে আন‌ন্দের ই‌তি ঘটায়, য‌দিও আন‌ন্দের কিছু রেশ থে‌কে যায়। 

মৃত্যু মা‌নে জীব‌নের ‌শেষ সীমা‌রেখা। এই সীমা‌রে‌খোর বাই‌রে তার কিছু করার থা‌কে না। কিন্তু মজার বিষয় হল মানুষ মারা গে‌লে জন্ম‌দি‌নের চে মৃত্যু‌র দিনকে বে‌শি ঘটা ক‌রে পালন ক‌রে। মানুষ যেমন ক‌ষ্টের গান, ক‌ষ্টের ক‌বিতা, ক‌ষ্টের সি‌নেমা দে‌খে চো‌খের জল ফেল‌তে পছন্দ ক‌রে তেম‌নি মৃত মানু‌ষের জন্য শোক প্রকাশ ক‌রেও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেল‌তে স্বাচ্ছন্দ্য‌বোধ ক‌রে। আমরা যাই ক‌রি না কেন, তার পেছ‌নে কিন্তু জন্ম। ফ‌লে আমি যেকারও জন্ম‌দিন তার মৃত্যু‌দি‌নের চে বে‌শি ক‌রে উপ‌ভোগ ক‌রি। কি‌ লিখ‌তে গি‌য়ে কি লি‌খছি নি‌জেও জা‌নি না। বোধহয় কিছুটা অ‌হেতুক বা‌জে পা‌ণ্ডিত্য জা‌হির ক‌রে ফেললাম। 

আজ ৩০ জুন। যারা সা‌হিত্য ক‌রেন, সাহিত্য প‌ড়েন, যারা আহমদ ছফা‌কে ভা‌লোবা‌সেন তা‌দের কা‌ছে এ দিনটির প্র‌তি খা‌নেকটা দরদ আ‌ছে বৈ‌কি। সাহি‌ত্যের রাজকুমার মনীষী লেখক আহমদ ছফা এই‌ দি‌নে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাই‌শের গাছবা‌ড়িয়া গ্রা‌মে জ‌ন্মেছি‌লেন। কাগ‌জে কল‌মে সালটি ছিল ১৯৪৩। সে হি‌সে‌বে তি‌নি বেঁ‌চে থাক‌লে আজ তাঁর বয়স দাঁড়াত ৭৮ বছর। কিন্তু আহমদ ছফার হি‌সে‌বে তাঁর জন্ম আরও এক বছর আ‌গে। স্কুল সা‌র্টিফি‌কেট পরীক্ষায় তাঁর শিক্ষ‌কেরা বয়স এক বছর কমি‌য়ে দি‌য়েছ‌িলেন। সেটি ধর্ত‌ব্যে নি‌লে আজ আহমদ ছফা ৭৯ বছর বয়সী হ‌তেন। ত‌থ্যের খা‌তি‌রে এসব বলা। কাগ‌জে কল‌মে যেটি সেটি‌কে হি‌সে‌বে নি‌লে আজ আহমদ ছফার ৭৮তম জন্মবার্ষিকী। 

আহমদ ছফার জন্মবা‌র্ষিকী কিংবা মৃত্যুবা‌র্ষিকী যেটাই সাম‌নে অাসুক আমার বু‌কের ভেতর থে‌কে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনাপনি বেরি‌য়ে আ‌সে। আ‌মি কখনও মে‌নে নি‌তে পা‌রি না অকা‌লে তাঁ‌কে কেন চ‌লে যে‌তে হয়ে‌ছিল। ৫৮ বছর এমন কি আহাম‌রি বয়স। কত মানুষই তো একশ বছ‌রের অধিক দিব্যি বেঁ‌চে আ‌ছে।  নিয়তিকে ফাঁকি দেয় সাধ্য কার! আহমদ ছফা নিয়তির শিকার হ‌য়ে‌ছি‌লেন, তার চে প্র‌তিকূলতার বলি। সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি এমন কি দু‌বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা কোনটাই তাঁর অনুকূ‌লে ছিল না। ফ‌লে শারী‌রিক অসুস্থতা তাঁ‌কে যেভা‌বে পে‌য়ে ব‌সে‌ছিল তার চে মান‌সিক অশা‌ন্তি তাঁ‌কে তি‌লে তি‌লে মৃত্যুর দি‌কে ঠে‌লে দি‌য়েছিল।

আহমদ ছফার প্রসঙ্গ এ‌লে হাজার কথা ভিড় ক‌রে। তি‌নি লেখক হি‌সে‌বে যত না অনুস্মরণের, তার চে মানুষ হি‌সে‌বে ছি‌লেন অনন্য। তাঁকে কা‌ছে থে‌কে না দেখ‌লে, দীর্ঘদিন তাঁর স‌ঙ্গে না মিশ‌লে মানুষ আহমদ ছফা‌কে বোঝা সম্ভব নয়। মেধার মালিক অ‌নে‌কে হয়, কিন্তু মানুষ হওয়ার যোগ্যতা খুব কম লো‌কেই অর্জন কর‌তে পা‌রে। দে‌শে আমরা যারা সততার কথা বলি তার বে‌শির ভাগই সু‌বিধাবাদী। আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমা‌নের মনজগত অনুসন্ধান কর‌তে গি‌য়ে সুবিধাবাদিতার সন্ধান পে‌য়েছি‌লেন। সেজন্য আহমদ ছফা বাহবাও পে‌য়ে‌ছেন। কিন্তু আহমদ ছফা‌কে আমরা যারা ধারণ করার কথা ব‌লি, আমরা কি সে সুবিধাবাদিতা থে‌কে বে‌রি‌য়ে আস‌তে পে‌রে‌ছি? হা‌সি পায়। আমরা তো যখন তখন গিরগি‌টির ম‌তো রঙ বদলাই। সু‌যোগ পে‌লে যেখা‌নে সেখা‌নে অাঙুল দেই, কিন্তু নি‌জের হীনমন্যতার কথা ভাবি না। আহমদ ছফা ওই প্রকৃ‌তির মানুষ ছি‌লেন না। এখা‌নে তি‌নি ছি‌লেন ব্য‌তিক্রম, এখা‌নে তি‌নি অনন্য। 

আমি আ‌গেই ব‌লে‌ছি, আমার কা‌ছে জন্ম‌দিনটি গুরুত্বপূর্ণ, মৃত্যু‌দিন নয়। ‌জ‌ন্মের পর থে‌কে আমি মানু‌ষের সৌন্দর্য দেখি। আমি তার সৃ‌ষ্টি‌কে দেখি, তার সৃ‌ষ্টি‌কে ভা‌লোবা‌সি। আমি আহমদ ছফার ম‌ধ্যে শুধু সৃষ্টিই দে‌খে‌ছি। তিনি ছি‌লেন সৃ‌ষ্টির উল্লা‌সে মে‌তে থাকা মানুষ। ছোটকাল থে‌কে তিনি নি‌জে‌কে ব্য‌তিক্রম ধারায় তৈরি করতে প্রয়াসী ছি‌লেন। এজন্য হয়‌তো তাঁর বাবা ব‌লে‌ছি‌লেন, আমার ছে‌লে‌টি আ‌গের যু‌গে জন্মা‌লে পয়গম্বর হত। এলাকার মানুষ বলত, ধন মিয়ার ছে‌লে আলাওল ব‌নে গে‌ছে। তার মা‌নে ক‌বি হ‌য়ে গে‌ছে। এ কথাগু‌লো এমনি এমনি তো ছড়ায়‌নি।

আমার এ ছোট বয়‌সে অ‌নেক মানু‌ষের শৈশব, কৈ‌শোর, তারুণ্য এবং বার্ধক্য দে‌খেছি। যে কারও শৈশব, কৈ‌শোর এবং তারুণ্য আ‌মি দারুণভা‌বে উপ‌ভোগ করি। মানু‌ষের এ পর্যায়গু‌লো আমার চো‌খে ভা‌সে। আমি আহমদ ছফাকে শিশু কিংবা কি‌শোর বয়‌সে দে‌খি‌নি, তাঁর তারুণ্য দে‌খেছি, এক‌জন সুদর্শন একহারা গড়‌নের টগব‌গে যুবক। কী‌ তাঁর উচ্ছ্বলতা! ধী‌রে হাঁটার অভ্যাস ছিল না তাঁর। দু হাত মু‌ষ্টিবদ্ধ ক‌রে টান টান বু‌কে যেন বাতাস‌কে দু ভাগ ক‌রে হেঁ‌টে যে‌তেন। তাঁর বাম পা একটু লম্বা ছিল বোধকরি। এজন্য এ পা-‌টি ‌টে‌নে টে‌নে হাঁট‌তেন, কিন্তু মন্দ লাগত না। এ পা‌য়ের জু‌তোর তলা খা‌নেকটা মা‌টি‌তে ঘষা খেত। যে কার‌ণে তাঁর বাঁ পা‌য়ের জু‌তোটি আ‌গেভা‌গে নষ্ট হ‌য়ে যেত। লেখা এবং খাওয়া বা‌দে বাঁ হাতটি সব কা‌জে ব্যবহার করার অভ্যাস ছিল।

আহমদ ছফার কথা এ‌লে কতকিছুই তো মনে প‌ড়ে। সবসময় তি‌নি একটু ব্য‌তিক্রমধর্মী পোশাক পর‌তে পছন্দ কর‌তেন। কোন কাপড় তাঁ‌কে এক মা‌সের বে‌শি পর‌তে দেখা যেত না। কিছু‌দিন পরার পর সে কাপড় তিনি অন্যকাউ‌কে দি‌য়ে দি‌তেন। তাঁর গা‌য়ের অ‌নেক কাপড় পরার সৌভাগ্য আমার হ‌য়ে‌ছে। এখনও তাঁর দেয়া কাপড় মা‌ঝে মা‌ঝে পরে আমি অতী‌তে ফি‌রে যাই। ব্যতিক্রমধর্মী ছিল তাঁর কথাবার্তা, ব্য‌তিক্রম ছিল চলা‌ফেরা। অন্য দশজ‌নের স‌ঙ্গে তাঁ‌কে মেলা‌নো যেত না। তাঁর চোখ মুখ একস‌ঙ্গে কথা বলত। যখন তি‌নি রে‌গে যে‌তেন কিংবা বিরক্তিবোধ কর‌তেন তখন ঠোঁটকে সূঁচা‌লো ক‌রে ফেল‌তেন। কখনও কখনও চো‌খের চাহনি পা‌ল্টে দি‌তেন, কিংবা ভ্রূ কুঁচ‌কে বির‌ক্তির চর‌ম প্রকাশ ঘটা‌তেন। কোন‌কিছু পছন্দ না হ‌লে শিস দি‌য়ে তা উড়িয়ে দি‌তেন। কারও কথায় কা‌জে অসঙ্গতি দেখ‌লেই স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে অন্যরকম আহমদ ছফা‌য় প‌রিণত হ‌তেন। অহংকার করার ম‌তো তাঁর অ‌নেক কিছুই ছিল। কিন্তু অহংকারী ছিলেন না। সবসময় নি‌জে‌কে একজন তুচ্ছ মানুষ হি‌সে‌বে প‌রিচয় দি‌তেন, কখনও নি‌জে‌কে বড় ক‌রে দেখা‌তেন না।

সবসময় তিনি হাসিখু‌শি থাক‌তেন। যখন হাস‌তেন তখন তাঁ‌কে শিশুর ম‌তো দেখাত। শব্দ ক‌রে খুব কমই হাস‌তেন। ‌সোজা হ‌য়ে হাঁটা, সোজা হ‌য়ে বসা, সোজা হ‌য়ে শোয়ায় তি‌নি অভ্যস্ত ছি‌লেন। মেরুদন্ড বাঁকা মানুষ‌কে তিনি পছন্দ কর‌তেন না। তি‌নি ম‌নে কর‌তেন মেরুদন্ড বাঁকা মানুষ ভীরু প্রকৃ‌তির।  

আহমদ ছফা ছি‌লেন টে‌বি‌লের মানুষ। সবসময় পড়া আর পড়া। হা‌তে সিগা‌রেট, স‌ঙ্গে লাল চা। তাঁর আর কী চাই! কখনও কখনও বল‌তেন, আমা‌কে য‌দি তিন‌দিন বই‌ এবং সিগা‌রেট ছাড়া কোথাও বন্দী ক‌রে রা‌খে আ‌মি মারা যাব। 

হার‌মোনিয়ামটাও তাঁর অনুসঙ্গ ছিল। পড়ার ‌টে‌বিল থে‌কে উ‌ঠে তিনি কিছুক্ষণ হার‌মোনিয়াম বাজি‌য়ে গান গাই‌তেন। অসুখ বিসুখ, মন খারা‌পের সময়ও হার‌মো‌নিয়াম বাজি‌য়ে গান ক‌রে মন‌কে হালকা করার চেষ্টা কর‌তেন। 

শরী‌রে নানারকম অসুখ বাসা বেঁ‌ধে‌ছিল। হাঁপানি, পাইলস, অ্যাক‌জিমা, ডায়া‌বে‌টিস, দাঁ‌তের ব্যথা প্রায় লে‌গে থাকত। কখনও তাঁ‌কে অসুস্থতার নাম ক‌রে শু‌য়ে থাকা কিংবা কাজ‌কে এ‌ড়ি‌য়ে যে‌তে দে‌খি‌নি। অসুস্থতা নি‌য়ে‌ কখনও হাহুতাশও কর‌তেন না। তি‌নি যে অসুস্থ তা কারও কা‌ছে প্রকাশ ক‌রাও ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। কেউ য‌দি জি‌জ্ঞেস কর‌তেন, কেমন আ‌ছেন?

জবা‌বে বল‌তেন, ভা‌লো থাকার চেষ্টা কর‌ছি।

ভা‌লো আছি বলাটা এক ধর‌নের মিথ্যা বলা। আবার ভা‌লো নেই বলাইও তি‌নি অভ্যস্ত নন। 

কখনও কখনও তাঁর বিশ্রা‌মের খুব দরকার পড়ত। তখন তি‌নি শুই‌য়ে পড়‌তেন। বল‌তেন, কেউ এ‌লে বল‌বে আমি ঘুমি‌য়ে প‌ড়ে‌ছি। তখন হঠাৎ কেউ চ‌লে আমরা বলতাম, উনার শরীর ভা‌লো নেই, ‌তিনি ঘু‌মি‌য়ে‌ছেন। আপনি অন্যসময় আসুন। 

এ কথা আহমদ ছফার কা‌নে যে‌তে '‌কে' ব‌লে তিনি বিছানা থে‌কে উ‌ঠে সাম‌নে চ‌লে আস‌তেন। যখন বলা হত, আপনার ঘুমা‌নো দরকার।

আহমদ ছফা হে‌সে বল‌তেন, আ‌মি তো ঘুমাইনি, মিথ্যা বলার কি দরকার। তাছাড়া এত কষ্ট ক‌রে এ‌সে‌ছে ফিরি‌য়ে দেয়া কি ঠিক হ‌বে?

এসব নি‌য়ে মা‌ঝে মা‌ঝে আমা‌দের বিব্রতকর অবস্থায় পড়‌তে হত।

তাঁকে অন্যকারও স‌ঙ্গে মেলা‌নো দুষ্কর। এ‌কেবা‌রে স্বতন্ত্র একজন মানুষ ছি‌লেন তি‌নি। তাঁর কথা বলার ধরন, চলা‌ফেরা, পোশাকপ‌রিচ্ছদ, চিন্তা‌চেতনা সবকিছু তি‌নি নি‌জের ম‌তো ক‌রে তৈরি ক‌রে নি‌য়েছি‌লেন। সব ধর‌নের গান তি‌নি একই সু‌রে গাই‌তেন, এমন কি কোরান পাঠও। কোনকিছু‌কে তিনি হেলা ক‌রে দেখ‌তেন না। যা কর‌তেন সব‌কিছু‌কে তি‌নি কাজ হি‌সে‌বে নি‌তেন এবং দা‌য়ি‌ত্বের অংশ ম‌নে কর‌তেন। সবসময় মাথায় নানাচিন্তা কাজ করত ব‌লে তাঁর ভেতরে এক ধর‌নের অ‌স্থিরতা কাজ করত। আবার ধৈর্য্যশ‌ক্তিও ছিল অসাধারণ। একটা কা‌জের পেছ‌নে দীর্ঘ‌দিন শ্রমসাধনা ক‌রে শেষ দেখার চেষ্টায় ‌তি‌নি বি‌ভোর থাক‌তেন। 

আড্ডা তি‌নি দি‌তেন, কিন্তু  সে আড্ডায় খুব কমই হালকা বিষয় স্থান পেত। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃ‌তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন কোন না কোন বিষয় তাঁর কথায় চ‌লে আসত। সব‌ কথার ম‌ধ্যে একটা মৌলিক চিন্তা কাজ করত। স্মরণশ‌ক্তি ছিল অসাধারণ, যা পড়‌তেন তা ম‌নে রাখ‌তে পার‌তেন। কিন্তু তি‌নি তা কমই জাহির কর‌তেন। নি‌জে‌কে সমৃদ্ধ করার জন্যই তাঁর পড়াশুনা, কিন্তু সে‌টি অ‌ন্যের কা‌ছে প্রচার ক‌রে পণ্ডিতি কর‌তেন না। একটা কথা তিনি বল‌তেন, মানুষ‌কে প‌ণ্ডি‌তি কর‌তে নেই। এই  পণ্ডি‌তি না করার কার‌ণে হয়‌তো আহমদ ছফা সবসময় মৌ‌লিক। তি‌নি কোড ক‌রে লেখা লিখ‌তেন না, লিখ‌লেও কখনও সখনও। মৌ‌লিক এবং জাত লেখ‌কের এটা বড় এক বৈশিষ্ট্য।

আহমদ ছফার বড় একটি গুণ ছিল সময়‌কে মূল্য দেওয়া। কখনও তাঁ‌কে সূর্য ওঠার প‌রে ঘুম থে‌কে জাগ‌তে দেখা যেত না। রাত এগারটা বাজ‌লে তি‌নি শুই‌য়ে পড়‌তেন। টানা ঘুম খুব কমই ঘু‌মো‌তেন। ফ‌লে মাঝরা‌তেও তি‌নি পড়ার টে‌বি‌লে হা‌জির হ‌তেন, না হয় হার‌মোনিয়া‌মে গলা সাধ‌তেন। খুব ভো‌রে মশারির ভেত‌রে ব‌সে এক ঘণ্টা ধ্যান করার মধ্যদি‌য়ে তাঁর দি‌নের কাজ শুরু হত। তাঁর বাড়ি‌তে কেউ দীর্ঘ সময় ঘু‌মি‌য়ে থাক‌বে সে‌টি তিনি পছন্দ কর‌তেন না। এ দীর্ঘ ঘু‌মের জন্য যে কাউ‌কে ঘর থে‌কে বের ক‌রে দি‌তে তি‌নি দ্বিধা কর‌তেন না।

বাঙালির যে সময়জ্ঞান তার থে‌কে আহমদ ছফা সম্পূর্ণরু‌পে মুক্ত ছি‌লেন। সময়‌কে খুব মূল্য দি‌তেন। ‌কোথাও যাওয়ার প্রোগ্রাম থাক‌লে তার এক ঘণ্টা আ‌গে ‌থে‌কে নি‌জে‌কে তৈ‌রি ক‌রে নি‌য়ে ব‌সে থাক‌তেন। কিন্তু যে তা‌কে নি‌য়ে ‌যে‌তে আসত সে দেরি‌তে এ‌লে তাঁর রাগ সপ্ত‌মে গি‌য়ে পৌঁছত। সময় ঠিক না রাখার কার‌ণে কখনও কখনও প্রোগ্রাম বাতিল কর‌তেন। কোন নির্ধা‌রিত প্রোগ্রা‌মে গে‌লে তি‌নি দশ বিশ মিনিট আ‌গে গি‌য়ে হা‌জির হ‌তেন। এই সময়টুকু কারও স‌ঙ্গে কথা ব‌লে কাটা‌তেন, নয়‌তো দাঁ‌ড়ি‌য়ে থে‌কে বই প‌ড়ে সম‌য়ের মূল্য দি‌তেন। 

তাঁর কা‌ছে এক মি‌নিট সময়ও ছিল অ‌নেক মূল্যবান। তি‌নি সবসময় বল‌তেন, আমা‌কে দিনরাত আঠা‌রো ঘণ্টা প‌রিশ্রম কর‌তে হয়। সুতরাং আমার এক মিনিট সময় নষ্ট করার অ‌ধিকার কারও নেই।

‌তি‌নি লোভী ছি‌লেন না। লোভ কর‌লে তি‌নি অ‌নেক কিছু কর‌তে পার‌তেন। অর্থ, ক্ষমতা, প্র‌তিপ‌ত্তি কোন‌কিছুর অভাব তাঁর হত না। সবসময় তি‌নি লোভ থে‌কে নি‌জে‌কে স‌াম‌লে রাখ‌তেন। তাঁর নির্ধা‌রিত কোন আয়ও ছিল না। আজ‌ এক‌বেলা কোন রক‌মে খে‌লেন, কাল কিভা‌বে খা‌বেন তা নি‌য়ে তাঁ‌কে চিন্তা কর‌তে দে‌খা যায়‌নি। এত দুঃসময় এবং আ‌র্থিক অনট‌নের সম্মুখীন তাঁ‌কে হ‌তে হ‌য়ে‌ছে, তাঁর শরীরই তার সাক্ষ্য দিত। 

চাকরি তি‌নি কখনও ক‌রেন‌নি। চাক‌রি‌কে খুব ভয় পে‌তেন। হুকুম মে‌নে কাজ করা তাঁর ধাঁ‌তে ছিল না। খাই না খাই স্বাধীন থাক‌তে পছন্দ কর‌তেন। ঢাকা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ে মাস্টা‌রি করার একটা সম্ভাবনা হয়‌তো দেখা দি‌য়ে‌ছিল। বোধক‌রি সে‌টি তাঁর পছন্দও ছিল। পছন্দ ছিল বল‌ছি এ কার‌ণে, আমার বয়স তখন অল্প। তিনি আমার বড় ভাই‌কে একখানা চি‌ঠিতে লি‌খেছি‌লেন, আমি ঢাকা বিশ্বাবদ্যাল‌য়ের অধ্যাপক হ‌তে চ‌লে‌ছি। ‌কিন্তু কেন সে‌টি হয়নি তা জানা যায়নি।

না পাওয়ার বেদনায় তি‌নি কখনও হতাশ হ‌তেন না। হিংসা, নিষ্ঠুরতা, প্রতি‌শোধ পরায়নতা তাঁর চরি‌ত্রের স‌ঙ্গে এ‌কেবা‌রে বেমানান ছিল। জীব‌নে নানারকম অত্যাচার এবং প্রতারণার শিকার তি‌নি হ‌য়ে‌ছেন, তা নি‌য়ে তাঁ‌কে কখনও টুঁ শব্দ কর‌তে দে‌খা যায়‌নি। কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি পর্যা‌য়ে যখনই কোনরকম অসঙ্গ‌তি কিংবা নষ্টামি চো‌খে প‌ড়ে‌ছে তখনই দেখা গে‌ছে আহমদ ছফা‌কে প্র‌তিবাদী হ‌য়ে উঠ‌তে। কাজটি তাঁর জন্য সহজ ছিল না। এসব কর‌তে গি‌য়ে ব্যক্তিজীব‌নেও তি‌নি সুখী হ‌তে পা‌রেন‌নি, তাঁকে পড়‌তে হ‌য়ে‌ছে নানা রোষান‌লে। নি‌জের ক্ষ‌তি হ‌বে জে‌নেও তি‌নি কখনও আদর্শ থে‌কে বিচ্যুত হ‌ন‌নি। এ বিচ্যুত না হওয়ার পেছ‌নে ছিল তাঁর সাহসী ম‌নোভাব। এ সাহস‌কে পুঁজি ক‌রে তিনি আজীবন পথ চ‌লে‌ছেন। মুক্তধারার বই‌য়ের ক্যাটাল‌গে অ‌নেক আ‌গে একটা লেখা প‌ড়েছিলাম, "সত্য‌কে গোপন করা এবং মিথ্যা‌কে ঢে‌কে রাখা আহমদ ছফার স্বভাব নয়।' আমার কেন জানি ম‌নে হয়, সত্য‌কে ধারণ ক‌রে মিথ্যার বিরু‌দ্ধে আঙুল তু‌লে কথা বলার অর্থ আহমদ ছফা।

তি‌নি ছি‌লেন এক বিস্ময়কর মানুষ, জ্যোতির্ময় নক্ষ‌ত্র। তাঁর কথায়, কা‌জ‌ে, লেখনী‌‌তে অর্থাৎ পু‌রো জীবন জু‌ড়ে ছিল বিস্ময়ের ছড়াছ‌ড়ি। ক‌বি নজরু‌লের সে কথাটি আহমদ ছফার স‌ঙ্গে মি‌লে যায়, 'উ‌ঠিয়া‌ছি চির বিস্ময় আ‌মি বিশ্ব বিধাত্রীর।'

আজ এ বিস্ময়মানব আহমদ ছফার ৭৯তম জন্মবার্ষিকী। শ্রদ্ধা এবং ভা‌লোবাসা জানাই তাঁর তাবৎ স্মৃ‌তি ও সৃষ্টির প্র‌তি।

৩০/০৬/২০২২

ডেস্ক রিপোর্ট 

সৌজন্যে বাদুস

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন