//ভালোবাসার সেকাল//অভিনেতা আফজাল হোসেন

//ভালোবাসার সেকাল//অভিনেতা আফজাল হোসেন


-রেডিও শহর ডেস্ক
 


অল্প স্বল্প দীর্ঘজীবন- ৬৪


আব্বা খুশী। আম্মা দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে ফেললেন আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে। আব্বার ছোটোজন, ছোটো ভাইয়ের নাম আসাদ হোসেন। আমাদের ছোটোকাকা। আব্বা তাঁকে ডাকেন, ছোটো খোকা। অন্য কাকারা সবাই ডাকেন, ছোটো ভাই বলে। 


আমাদের সেই ছোটো কাকা দেখতে ছিলেন সিনেমার নায়কদের চেয়েও সুন্দর। ফর্সা গায়ের রং। সাদা বা হাল্কা রঙের পোশাকে সদা ফিটফাট। হাঁটা চলায় রাজকীয়। সর্বদা থাকতেন গম্ভীর হয়ে। কপালের মাঝখানে গভীর ভাঁজ পড়ে থাকতো সবসময়। দেখে মনে হতো এই পৃথিবীটা মোটেও আনন্দদায়ক নয়, খুবই বিরক্তিকর জায়গা। এখানে আসা তাঁর উচিত হয়নি, কপাল দোষে এসে পড়েছেন। 


এমন না হলে মুখ গোমড়া করে থাকতেন কেনো? একটুও হাসবেননা বলে মনে মনে যিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন- এমন মনে হতো যাকে, তিনি আফজাল পাশ করেছে শুনে এমন বড় করে হাসলেন, সবাই সেই হাসি দেখে অবাক, নিজেদের উচ্ছাস থমকে গেলো। পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সকলে। পরীক্ষা দেবার লম্বা সময়টাতে একদিনের জন্যেও মনে হয়নি, আমার পরীক্ষা নিয়ে ছোটোকাকার কোনও দুশ্চিন্তা ছিল- পাশ করে গেছি শুনে তিনি দারুণ খুশীতে, উচ্ছসিত হয়ে জোরে জোরে কথা বলা শুরু করে দিলেন । 


আমি যেনো যুদ্ধ জয় করে ফিরেছি। এমন হাবভাব চতুর্দিকে। পুরো বাড়ির মানুষের স্বভাব বদলে গেলো। কারণে অকারণে সকলেই হা হা হি হি হো হো করে হাসছে আর এ বাড়ির মানুষেরা যে কাজ করেনা কখনও- সকলেই প্রানখুলে কথা বলছে- হাসাহাসি, আনন্দপ্রকাশও চলছে প্রাণ খুলে। এমনটা এ পরিবারে আগে কখনো ঘটেনি। কেউ দেখেছে বলে দাবী করতে পারবেনা। 


রেজাল্ট বের হয়ে গেলো- আমার ভালো মন্দ কোনরকম অনুভূতি নেই। সবার চেহারা, ভাব ও ভাষা খেয়াল করি। খেয়াল করছি সেটা আবার কাউকে বুঝতেও দেইনা। আব্বা বাইরে অনেকের সাথে কথা বলছিলেন। আত্মীয়স্বজন, পরিচিত অনেকেই আসছেন- সবার মনেই ফলাফল জানবার আগ্রহ, উত্তেজনা- কি কইরলো আফজাল। ডাক্তারবাড়ি এইসেছি, খুশীর খবরে পেট পুরে মিষ্টি খাতি হবেনে।


আব্বা রেজাল্ট জেনে আসবার পথেই মিষ্টি কিনে এনেছেন। অত্যন্ত আনন্দিত গলায় তাঁকে বলতে শুনি - পাশ সে করবে, বিশ্বাস ছিল মনে। ফেল করার মতো ছাত্র সে না। পড়াশোনায় মনযোগ থাকলি আরও ভালো করতি পাইরতো। ছোটো কাকাকে কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুনি, আমি এক ছটাকও চিন্তা করিনি, বাড়ির সবাই তারে নে কত যে চিন্তা কইরেছে…আমি শুধু দ্যাখতাম, বলতামনা কিছু।


আম্মা ঠিক করলেন, এতো ভালো খবরের পর নলতায় যাওয়া কর্তব্য। দুপুরে খাওয়া সেরে আমাকে নিয়ে নলতা শরীফে যাওয়া হবে। অনেকদিন পারুলিয়া ছেড়ে সাতক্ষীরাতে আছি। সাতক্ষীরা টু কালিগন্জের বাস পারুলিয়ার উপর দিয়ে নলতা যাবে। আম্মাকে বলি, নেমে কি আমরা বাড়ি ঘুরে আসবো। আম্মা হেসে বলেন, দুদিন পর তো চইলে যেতি হবেই, তাহলি পর এখন নামার দরকারডা কি?


নলতা গ্রামে আমার স্কুল। সে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, হজরত খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ। তিনি কোনও সাধারণ মানুষ ছিলেননা। নাম উচ্চারণের আগে সন্মান জানাতে মানুষ হজরত শব্দ উচ্চারণ করতেন। 


ছিলেন সূফী সাধক- লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে তিনি পীর সাহেব। আমি যখন নলতা স্কুলে ভর্তি হই- তিনি বেঁচে নেই কিন্তু সেই স্কুলজীবনে ছাত্রছাত্রীদের অনুভবের মধ্যে তাঁর উপস্থিতি সর্বদাই  ছিল প্রবলভাবে। 


অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের উপ পরিচালক ছিলেন এই জ্ঞানতাপস। ব্রিটিশ সরকার দিয়েছিলেন খান বাহাদুর উপাধি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগের থেকেই পীর সাহেবের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে সূত্রে আমি সম্বোধনের প্রয়োজনে ডাকতাম পীর দাদুজান বলে। 


সে মাজার শরীফ দোতলা সমান কৃত্তিম পাহাড়ের উপরে নির্মিত। সবুজ পাহাড় ঘিরে ফুটে থাকে বিচিত্রবর্ণের, আকৃতির ফুল। সেইসব ফুলের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে চড়ার মতো করে উপরে উঠতে হয়। নামার সময় অনেকটা পথ পিছনে হেঁটে নামতে হতো- সন্মান প্রদর্শনের জন্য এটা ছিল নিয়ম। 


সে মাজার শরীফে গেলে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করতো। আতর আগরবাতির ঘ্রাণ, মাজার ঢাকা নকশা করা চকচকে চাদরের উপর দিয়ে আঁকা বাঁকা সরু রেখায় ধোয়া উড়ে যেতে দেখতাম।  উপর থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ে থাকতো সাদা মার্বেলের মেঝেতে। সে আলোর মধ্যে ধোঁয়া ঢুকে পড়ে ঘুরপাক খেতে থাকতো, ঘুরপাক খেতে থাকতো।  সে ঘুরপাক খাওয়া দেখে মনে হতো, ধোঁয়ারও প্রাণ রয়েছে। মনে হতো, আলোকরশ্মির মধ্য থেকে বের হতে পারছেনা- প্রাণপনে বের হওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। 


সবচেয়ে দেখতে ভালো লাগতো মাজার শরীফের অন্দরসজ্জা। ইটের গাঁথুনি হয়ে গেছে তখন, শুনেছি পুরো দেয়াল সাদা মার্বেলে মুড়ে দেয়া হবে। তার আগ পর্যন্ত সাদা কাগজ দিয়ে চার দেয়ালের ইট ঢেকে রাখা হয়েছিল। তার উপর রঙীন ঘুড়ির কাগজ কেটে নকশা বানিয়ে সেঁটে রাখা হতো। সেই কাগজ কাটা নকশা হা করে দেখার মতো ছিল। দেখতাম আর মনে হতো, আর কদিন পরেই তো আমি ঢাকায় যাচ্ছি। 


আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যাবো। তারপর কিছুদিন পরে কোনও ছুটিতে পারুলিয়া গ্রামে ফিরে আসবো। তখন আমি আর আগের আমি নেই। ঢাকা থেকে ছবি আঁকা শিখে এসেছি। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, তাঁদের চেনা আফজাল একজন শিল্পী হয়ে এসেছে। পিছনে পিছনে ছোটো বড়ো নানা বয়সী মানুষেরা হাঁটবে, কি কি আঁকতি পারো খোকা, আমাদের এট্টু দেখালি তো পারো। 


হয়তো তখন আমি রঙ্গীন কাগজ দিয়ে সুন্দর নকশা কাটা শিখে যাবো। এখানে আসবো তখন, আসবো সাদা দেয়াল সাজিয়ে দিতে। 


সামনের নকশা দেখতে দেখতে বাম দিকে ঘুরতেই আম্মার চোখে চোখ পড়ে। চোখের ঈশারায় তিনি এদিক ওদিক তাকাতে মানা করেন, বলেন দোয়া পড়ায় মনোযোগী হতে। ডানদিকে সাদা পোশাকে খাদেম সাহেব মাথা নিচু করে দোয়া দরুদ পড়ছেন। একটু পর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায়ের জন্য হাত তুলবেন। সন্তানের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য পূন্যবান মানুষ হাত তুলবেন, এই আশায় আম্মা পবিত্র স্থানে নিয়ে এসেছেন আমাকে।


ডেস্ক রিপোর্ট  Gwa

তথ্যও ছবি বরেণ্য অভিনেতা 

আফজাল হোসেন এর ফেসবুক পোস্ট থেকে 



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন